vai vai

ভাই ভাই

যদিও আমাকে বারংবার সতর্ক করা হয়েছিলো যে, নটা-সাড়ে নটার মাঝেই যেনো উপস্থিত হই। জুম্মার নামাজে নাকি এতোটাই সকাল সকাল যেতে হয়। নইলে মসজিদের ভেতর জায়গা পাওয়াই যাবে না। বাইরে রোদের মধ্যেই বসতে হবে। গরমে অনেক কষ্ট হবে। মসজিদে বসতে পারলে অন্তত এসির ঠাণ্ডায় আরাম লাগবে। কিন্তু আমি সতর্কবাণীকে খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। ভাবলাম সাড়ে ১০টার দিকে গেলেই হবে। কিন্তু হায় হায়, মসজিদে ঢুকার অনেক আগে থেকেই সবগুলি পথ বন্ধ এবং কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রীতিমতো পুলিশ দাড়িয়ে আছেন। যারাই একটু জোর করে ঢুকার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে সাথে সাথে বের করে দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র কয়েকজন অতি বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদেরকে ঢুকতে দেয়া হয়। তাও ভেবেছিলাম হয়তো একটু পরেই ঢুকতে দেবে। সেই আশায় আশায় প্রায় ২০ টা মিনিট ছাতা মেলে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা অনেক জন। যা রোদ রে বাবা! কিন্তু নাহ: ঢুকতে দিলোই না, তো দিলোই না।

অবশেষে মসজিদের বাইরের খোলা অংশে বসার ইচ্ছা করলাম। কারণ যদি আরো দেরি করি তাহলে নাকি রাস্তাতেই বসতে হবে। কিন্তু হায় হায়, শুধুমাত্র রোদ পড়েছে এমন খোলা জায়গাই বসার জন্য খালি পড়ে আছে। যেখানেই সামান্যও ছায়াটুকু আছে সেখানেই কেউ না কেউ বসে আছেন। প্রখর রোদে কেই বা বসতে চায়?

যেহেতু ছোট্ট একটা ছাতা সাথেই ছিলো, তাই আর দেরি না করে, বাধ্য হয়ে জায়নামাজ পেতে ছাতা খুলে বসে পড়লাম প্রখর রোদের মাঝেই (আমি ১ম জন)। বসতে না বসতেই আমার বাম পাশে আরেকজন জায়নামাজ পেতে বসলেন (ইনি ২য় জন)। কিন্তু আফসোস, তার ছাতা নাই। মাথার উপর ছোট্ট একটা রুমাল পেতে রোদ ঠেকাচ্ছিলেন কোনো মতে এবং প্রখর রোদের বর্ণনা দিচ্ছিলেন কিছুটা তার ভাষায় ও বাকিটা ইশারায়। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিতে ইশারা দিতেই তিনি কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে আমার কাছে বসলেন যেনো তিনিও আমার ছোট্ট ছাতার ছায়ায় একটু হলেও আরাম পান। আমিও ছাতাটা তার দিকে ঝুঁকিয়ে দেই। সাথে সাথে আরেকজন উনার বাঁপাশে ছাতা খুলে উত্তপ্ত মেঝেতেই বসলেন তার স্যান্ডেলের উপর। কারণ তার জায়নামাজ নাই (উনি ৩য় জন)। মেঝেও কিন্তু অনেক উত্তপ্ত! এবার ২য় জন আমার গা ঘেঁষে বসলেন এবং ৩য় জনকে ইশারায় বললেন যেনো তিনি স্যান্ডেল ছেড়ে তার জায়নামাজে বসেন। ৩য় জনও বুঝলেন যে, আমরা দুজন একটি ছাতা শেয়ার করছি। তখন তিনি তার ছাতাটাও আমার ছাতার সাথে ঠেকালেন যেনো আমরা তিনজনই ছাতার ছায়ায় আরাম পাই। ২য় জন, ৩য় জনের ছাতা ধরার দায়িত্ব নিলেন নিজ ইচ্ছায়। দুটি জায়নামাজের উপর, দুটি ছাতার নিচে তিনটি দেশের অপরিচিত তিনজন বসে আছি। এদিকে একে একে আরো অনেকে এসে বসতে বসতে পুরো কাতার ভরে পেছনে আরো অনেক কাতার হয়ে গেলো। জুম্মার সলাত শুরু হতে আরো অনেকটা সময় বাকি কিন্তু।

প্রখর রোদ, মেঝেও উত্তপ্ত। টপটপ করে ঘামছি, তৃষ্ণাও পাচ্ছে খুব – তিনজনেরই। আর ঐ যে তখন পুলিশ পাহারার জায়গায় প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করে ওখানেই বার বার পানি খেয়ে প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম আমার পানি। তাই আমার বোতলে সামান্য একটু পানি বাকি। বোতল আমার হাতেই। ৩য় জন ইশারায় ঐ সামান্য পানিটুকু চাইলেন। একজন তৃষ্ণার্তকে পানি পান করাবো আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য, আমি তো সাথে সাথে সানন্দে পানির বোতল দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ২য় জন আমাকে বাঁধা দিলেন। তিনি তার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট্ট বোতল বের করলেন, যেটাতে কিনা ঠাণ্ডা পানি ভরা। উনি কিছুক্ষণ আগেই বরফ ঠাণ্ডা পানি ভরে এনেছেন, সেটাও জানালেন। তৃষ্ণার্ত ৩য় জন প্রায় অর্ধেক ঠাণ্ডা পানি পান করলেন। বাকি অর্ধেক পানি পান করলেন পানির মালিক নিজেই। এবার ৩য় জন খালি বোতলগুলি চাইলেন পানি ভরে আনতে। আমাকেও তার ভাষাতে বললেন যেনো বাকি পানিটুকু পান করে বোতলটি খালি করে দেই। আমাদের দুজনের পানির বোতল বেশ কিছুটা দূর থেকে, ভিড় ঠেলে ভরে আনলেন উনি এই উত্তপ্ত রোদে। বোতল ধরতেই বুঝতে পারলাম উনি নরমাল পানি ভরে আনেন নাই। একদম ঠাণ্ডা পানি ভরেছেন। আহ্‌ কি শান্তি! আল্‌হাম্‌দুলিল্লাহ্‌। আমরা তিনজন সামান্য কিছু কথা বার্তাও বলেছিলাম একে অপরের সাথে পরিচিত হতে। এদিকে রোদের প্রখরতা বাড়ছেই আর বাড়ছে। অতপর খুৎবা শুরু, খুৎবা শেষ, সলাত শুরু। দুটি জায়নামাজে একসাথে তিনজন তো সলাতে দাঁড়ানই যায়। সলাত শেষে হাসি মুখে সামান্য সৌজন্য কথাবার্তা বলে যার যার মতো বিদায় নিলাম।

ঘটনা এখানেই শেষ। কেমন লাগলো সামান্য এই ঘটনাটুকু পড়ে? আমি আন্দাজ করতে পারছি এমন ঘটনা পড়ে মনের অনুভূতি কেমন হতে পারে! জায়নামাজ, ছাতা, আরামের ছায়া, ঠাণ্ডা পানি – সব ভাগাভাগি করলাম অপরিচিত তিনজন কোন রকম ঝগড়াঝাঁটি, ক্ষোভ, বিদ্বেষ আর ঘৃণা ছাড়াই। বিশেষ করে যিনি কষ্ট করে ঠান্ডা পানি ভরে আনলেন, তার কিন্তু নিজের কোনো পানির বোতল ছিলোই না। সকলের সবটুকু ছিলো শুধুমাত্র এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কোনো সন্দেহ নাই!

ঘটনা ২০১৩ ইং, মাসজিদুল হারাম, মক্কা।
লিখেছেন : শিবলি মেহেদী।

Share This Article
Tareq Hussain
Tareq Hussain